আরমানিটোলা নাম শুনে সবার আগে মাথায় যেটা এসেছিল তা হল আরমেনিয়ার সাথে কোন সম্পর্ক নেই তো? ব্যাপারটা মনে উঁকি দিয়েছিল নিছকই উচ্চারণগত মিলের জন্য। কিন্তু ব্যাপারটা যে আসলেই সত্যি সেটা কিন্তু একেবারেই কাকতালীয়। হ্যাঁ, সত্যিই আরমানিটোলা নামটি এসেছে ওই এলাকায় বসবাসরত আর্মেনিয়ানদের কারণেই। বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরের একটি রাষ্ট্র থেকে মানুষ এসে আমাদের এই পুরান ঢাকায় শুধু বসবাসই করেনি রীতিমতো স্থান করে নিয়েছিল ঢাকার জমিদারদের তালিকাতেও, ভাবা যায়!
আরমেনিয়া পৃথিবীর প্রাচীনতম দেশ গুলোর একটি। অনেক ‘প্রথম’ এর সাথেই আরমেনিয়ার নাম জড়িত। আরমেনিয়াই প্রথম দেশ যারা রাষ্ট্রীয় ভাবে খ্রিস্টান ধর্ম কে স্বীকৃতি দেয় ৩০১ সালে। প্রথম চার্চ ও তৈরি হয় আর্মেনিয়াতে। আর্মেনিয়ান বর্ণমালা পৃথিবীর আধুনিক বর্ণমালার তালিকায় শীর্ষে। শুরু থেকেই তারা জাতিগত-ভাবে ছিল আধুনিক এবং সহনশীল, যার পেছনে বড় কারণ ছিল ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক প্রভাব।
ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হলেও ভৌগোলিক অবস্থান এর কারণে আর্মেনিয়া কে বারবারই বিভিন্ন আগ্রাসী জাতিগোষ্ঠীর শাসনের কবলে পড়তে হয়েছে যাদের মধ্যে আছে পারসিয়ান, রোমান, গ্রীক, অটোমান এবং রাশিয়ান। এই বিভিন্ন ভাষার জাতিগোষ্ঠীর শাসনের সংস্পর্শে এসে আর্মেনিয়ানরা হয়েছে সমৃদ্ধ,চৌকস,ব্যবসায়িক যা তাদের পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের পথকে করেছে সুগম। আর তাইতো বিশ্বজুড়ে দেড় কোটি আর্মেনিয়ানদের মধ্যে মাত্র ত্রিশ লক্ষ থাকে আর্মেনিয়াতে!
আনুমানিক সপ্তদশ শতকের শুরুর দিকে এ দেশে আর্মেনীয়দের আগমন ঘটে। এ দেশে আসা আর্মেনীয়রা মূলত পারস্য অর্থাৎ ইরানের অধিবাসী ছিল। ফারসি ভাষা জানার কারণে এরা খুব সহজেই মুঘল সালতানাত এ কাজের সুযোগ পেয়ে যায়। আর তখনই তারা ঢাকায় চলে আসে এখানকার প্রসিদ্ধ কাপড়ের ব্যবসায় মনোযোগী হতে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংস্পর্শে আসা আর্মেনীয়রা খুব সহজেই আমাদের সাথে মিশে যায়।

কাপড়ের ব্যবসার পাশাপাশি তারা গানপাউডার এর কাঁচামাল সল্ট-পিটার, লবণ, মশলা, দামি পাথর, তুলা আর নীলের ব্যবসাও শুরু করে। উনিশ-শতকের দ্বিতীয়-ভাগে আর্মেনীয়রাই এদেশে পাট-ব্যবসা জনপ্রিয় করে তোলে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এ তারা পাটকল স্থাপন করে। সময়ের সাথে সাথে তারা নৌপরিবহন ব্যবসা, নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর পাইকারি ব্যবসাতেও মনোনিবেশ করে। একটা বিষয় না বললেই নয়, আর্মেনীয়রাই এদেশে ‘সুপার শপ’ ধারণার প্রবর্তন করে যেখানে তারা বিক্রি করত ইউরোপীয় পণ্য। ব্যবসায়ী হবার কারণে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এরা পুরান ঢাকার বাঙালীদের সাথে মিশে যায়।
নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ গ্রন্থে জানা যায়, ১৮৩৮ সালে ঢাকায় ৪০টি আর্মেনীয় ও ৩১২টি গ্রিক পরিবার ছিল। ‘বাংলাপিডিয়ায়’ বলা হয়েছে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এ অঞ্চলে আর্মেনীয়দের অবস্থানে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশে তাদের সঞ্চিত অর্থ-সম্পদসহ মধ্য এশিয়া-ইরানে ফিরে যেতে থাকেন। অনেকে পাড়ি জমান ইউরোপে।
ব্রিটিশদের শাসনের সময় আর্মেনীয়দের ইউরোপীয় হিসেবে গণ্য করা হত। ১৮৬৬ সালের আদমশুমারি অনুসারে তখন ঢাকাতে আর্মেনীয়দের সংখ্যা ছিল ১০৭। এদের মধ্যে একজন পাদ্রী, পাঁচজন জমিদার, ত্রিশ-জন ব্যবসায়ী আর চারজন ছিলেন সরকারী চাকুরে। আর্মেনীয়রা ব্রিটিশ দের খুব প্রিয় ছিল। প্রিয় হবার কারণ যে শুধু খ্রিস্টান তা নয় তারা একাধারে ছিল পরিশ্রমী এবং মেধাবী। বিশেষ করে তাদের ব্যবসায়িক কৌশল ছিল সর্বজন সমাদৃত।
ব্রিটিশরা যখন ধীরে ধীরে এদেশের কাপড়ের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করল আর্মেনীয়রা তখন এ শহরের জমি কেনায় মনোযোগ দিল। আর এভাবেই সময়ের সাথে সাথে তারা বনে গেল ঢাকা শহরের জমিদার। যাদের মধ্যে আগা আরাটুন মাইকেল, আগা সারকিস ও নিকোলাস মারকার পোগোসা ছিলেন অন্যতম। তাদের সামাজিক অবদানের কারণে মোঘল, বাংলার নবাব ও ব্রিটিশদের কাছ থেকে নানা রকম সম্মানসূচক উপাধিতে ভূষিত করা হত, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত উপাধি ছিল “খাজা”। “খাজা” উপাধিটি মূলত পারসি “খাওয়াজা” শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ মনিব বা প্রভাবশালী। এছাড়াও আরও একটা উপাধি বেশ প্রচলিত ছিল তা হল “ আঘা” বা “ আগা”। এ উপাধিটিও ফারসি থেকা আসা।
এ শহরে আর্মেনীয় আরও একটি সংযোজন ছিল ঘোড়ার-গাড়ীর প্রচলন যা “টিক্কা গাড়ী” নামেই বেশি পরিচিত পুরান ঢাকায়। ও ভালো কথা এ শহরে চা খাওয়ার অভ্যাস এসেছে আর্মেনীয়দের হাত ধরে। এছাড়া প্রথম বেসরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আর্মেনীয় জমিদার নিকোলাস পোগোসে এর আমলে। শাঁখারিবাজার এর মোড়ে সেই’ পোগজ স্কুল’ এখনও চলছে বহাল তবিয়তে। পোগোসের দেয়া পথ ধরেই ইংরেজ প্রশাসন ১৮৬৪ সালে ‘ঢাকা মিউনিসিপালিটি এক্ট’ প্রণয়ন করে যার মাধ্যমে ঢাকা মিউনিসিপালিটি একটি স্ব-নিয়ন্ত্রিত ও সুনির্দিষ্ট ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বলা যায় পোগোসের হাত ধরেই এদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটেছিল।
১৮৬৮ সালে ঢাকার জমিদারদের তালিকায় দেখা যায় ছয়জন ইউরোপীয় জমিদারের মধ্যে পাঁচজনই ছিলেন আর্মেনীয়। ঢাকার বাইরে বরিশালেও ছিল এদের জমিদারি। ঢাকা শহরের বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্ম, শিক্ষাবিস্তার আর সভা-সমিতির সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছিলেন আর্মেনীয়রা। পানি নিষ্কাশনের জন্য ধোলাই খালের কিছু অংশের পুনঃখনন এবং সেতু নির্মাণ, বাকল্যান্ড বাঁধ আর পোগজ স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তাদের হাতেই। ঢাকার প্রথম মিউনিসিপ্যাল কমিটিতে ছিলেন সার্কিস। ১৮৭৪-৭৫ সালে ঢাকা পৌরসভার ৯ কমিশনারের মধ্যে দুজন ছিলেন আর্মেনীয় জেজিএন পোগজ ও এনপি পোগজ।
ঢাকার আর্মেনিয়ান পরিবারগুলির কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাম ছিল: মিনাসিয়ান / মিনাস, আমিনাস / এমনিয়াস, মার্জারস, সার্ভারস, জর্জেস, পেট্রস / পেট্রোস, পোগোসেস, কেভেরকেস, আরাটুনস, মানুকস, ডেভিডস, ক্যাচ্যাটারস, স্টিফেনস, হাইকাজোনিস, ম্যাকারটিচস, বাগডাসারস, নহাপিটস, পেইনটিস / প্যানিয়েটিস, হার্নিস, লাজারস, লুকাস, অ্যাগাকিস, মাইকেলস, সার্কিজ / সার্কেস, জোয়াকিমস এবং থমাস।
স্থাপত্যশিল্পে আর্মেনীয়রা প্রাচীনকাল থেকেই উন্নত, বিশ্বের প্রথম চার্চও নির্মাণ করেছিল আর্মেনীয়রা। এ শহরে আর্মেনীয়দের বসবাসের সবচেয়ে বড় পোস্টার হল আরমানিটোলার তিনতলা বিশিষ্ট এই চার্চ। এদেশে আগমনের পরপরই আর্মেনীয়রা বসবাস শুরু করে ঢাকার তেজগাঁওতে। ১৬৭৭ সালে নির্মিত তেজগাও এর রোমান ক্যাথোলিক চার্চের সাথেই ছিল আর্মেনীয়দের কবরস্থান যা প্রমাণ করে তেজগাঁওই ছিল আর্মেনীয়দের আদি নিবাস। আরেকটি কবরস্থান ছিল বর্তমান আরমানিটোলায়। পরবর্তীতে এই কবরস্থানের সাথেই লাগোয়া কিছু জমি এগ্যামিনাস ক্যাটাচিক নামক এক আর্মেনিয়ান ভদ্রলোক চার্চ নির্মাণের জন্য দান করেন। তাঁর স্ত্রী সোফির সমাধি রয়েছে চার্চের ভেতরেই।
আরমানিটোলায় রয়েছে আর্মেনীয় গির্জা। ক্রুশ লাগানো হলুদ রঙের ঝকঝকে আর্মেনীয় গির্জা। ক্রুশের ঠিক নিচেই ইংরেজিতে লেখা প্রতিষ্ঠাকাল-১৭৮১। গির্জাটির নাম ‘চার্চ অব হোলি রেজারেকশন’। লোকে বলে আরমানিটোলা গির্জা। গির্জাটির জমি দান করেছিলেন আগা মিনাস ক্যাটচিক। আর নির্মাণে সাহায্য করেছিলেন চারজন ধনাঢ্য আর্মেনীয় ব্যবসায়ী। এরা হলেন: মাইকেল সার্কিস, অকোটাভাটা সেটার সিভর্গ, আগা এমনিয়াস ও মার্কার পোগজ। গির্জাটির চূড়ায় বাঁধা ঘণ্টা শেষবার বেজেছিল ১৮৮০ সালে। একসময় এ ঘণ্টাধ্বনি শুনে ঘড়ির কাঁটা ঠিক করত এলাকার মানুষ। পাঁচ মাইল দূর থেকেও শোনা যেত ঘণ্টার শব্দ। ১৮৫৭ সালের ভূমিকম্পে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এই গির্জা। শুরুতে এটা ছিল আর্মেনীয়দের কবরস্থান। পরে ৭৫০ ফুট লম্বা মূল গির্জাটি স্থাপিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ভ্রমণবিষয়ক একাধিক বইয়ের লেখক এলিজা বিনতে এলাহী আরমানিটোলা গির্জা নিয়ে বলেন, গির্জার চারপাশে এমনকি বারান্দাজুড়ে আছে অনেকগুলো সমাধি। অধিকাংশ এপিটাফে খোদাই করা ধর্মের বাণী বা প্রিয় কোনো উদ্ধৃতি, যা আমার বোধগম্য নয়। কিন্তু কারুকার্যময় এপিটাফগুলো একেকটি অনন্য শিল্পকর্ম। আঠারো শতকের সমাধিও আছে এখানে। আর আছে সুনসান শান্তির নীরবতা, যা ঢাকা শহরে খুঁজে পাওয়া মুশিকল।
ঢাকায় বসবাসরত আর্মেনীয়রা সংখ্যায় কম হলেও অনেক সম্পদশালী ছিল। সময়ের সাথে সাথে তাদের সংখ্যা কমতে থাকলেও দুই দেশের এই সুবিশাল দূরত্বের মাঝে বন্ধনের সেতু গড়ে দাঁড়িয়ে ছিল এই চার্চ।
চার্চ ঘুরে দেখা যায়, পুরনো কবরের এপিটাফগুলো সব মেঝেতে বিছানো। নতুন কিছু সমাধি মাটি থেকে ৬-৭ ইঞ্চি উঁচুতে। সমাধিগুলোর এপিটাফের ভাষা আর্মেনীয় ও ইংরেজি। দেখতে দেখতে কিছু এপিটাফের লেখায় চোখ আটকে যায়। ১৯২৯ সালে ২৪ বছর বয়সে মারা যাওয়া ম্যাক এস ম্যাকারটিকের এপিটাফে তার বাগদত্তার পক্ষ থেকে লেখা আছে, ‘খুব ভালোবাসতাম বলেই তাকে এতটা মনে পড়ে। আমার স্মৃতিতে সে খুব দূরের কেউ নয়। অজস্র বোবা কান্নায় এখনো তাকে ভালোবাসি, মনে করি, কাছে পেতে চাই।’ ১৮৭৪ সালে মাত্র তিন বছর বয়সে মারা গেছে কন্সট্যান্স পিটারস্। তার এপিটাফের ভাষাও কেমন নাড়া দিয়ে যায়:
‘আমার জন্য কেঁদো না তোমরা, কেন শোক করো? আর আমি তো হারিয়ে যাইনি, শুধু একটু আগে চলে গেছি।’
১৯৯৬ সালে মাদার তেরেসা যখন এদেশে ভ্রমণ করেন তখন তিনি এই চার্চেই অবস্থান করেন। কিছুদিন আগেও এদেশে আর্মেনীয় জনগোষ্ঠীর একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন মাইকেল জোসেফ মার্টিন। ১৯৪০ এর দশকে বাবার সাথে ঢাকায় আসে বার্মার রেঙ্গুন থেকে। বাবা ছিলেন পাটের ব্যবসায়ী। সময়ের সাথে সাথে ব্যবসার অবস্থা খারাপ হতে থাকলেও মারটিন সাহেব থেকে গিয়েছিলেন এদেশেই। করতেন চার্চের দেখাশোনা। মারা যাওয়ার আগে মার্টিন খুব চিন্তিত ছিলেন, তিনি মারা গেলে চার্চ কে দেখাশোনা করবে সেটা নিয়ে। তিনি আশা করতেন কানাডা থেকে তাঁর ৩ মেয়ের কেউ একজন হয়ত ফিরে আসবে!

২০২০ সালের ১১ এপ্রিল ৮৯ বয়সী মারটিন সাহেবের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এ শহরের সাথে আর্মেনীয় দের প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের সম্পর্কের অবসান হয়।
ভৌগোলিক ভাবে ছোট রাষ্ট্র হবার কারণে আমাদের দেশের জাতিগত বৈচিত্র্য নেই বললেই চলে। দেশের ৯৮ শতাংশ মানুষ বাঙালী, বাকি দুই শতাংশ উপজাতি। ফলে আমাদের ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে মেশা , সংস্কৃতির আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ হবার সুযোগ ও তেমনটা হয়ে ওঠে না অথচ আমাদেরও ছিল বহুজাতিক মিশ্রণের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। ভূ-রাজনৈতিক ও বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট হয়ত আগের মত অবাধ মেলামেশার সুযোগকে সীমিত করেছে। কিন্তু অতীতের এই সমৃদ্ধ এবং একই সাথে আকর্ষণীয় ইতিহাসের সংরক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ কে হাতছাড়া করা উচিত হবেনা।