ইতিহাস জুড়েই স্থাপত্য বা আর্কিটেকচার, সভ্যতার একটা আয়না হিসাবে কাজ করে আসছে। এই আয়নার কাজ হচ্ছে ঐ সভ্যতার মূল্যবোধ, সাফল্য এবং সময়ের সাথে সেই সভ্যতার পতনের প্রতিফলন দেখানো। বিভিন্ন আইকনিক স্ট্রাকচার থেকে শুরু করে সাধারণ ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য বিল্ডিংগুলো শুধু একটা শহরের ইতিহাসকেই ধরে রাখে না; ধরে রাখে আত্মাকেও। আমাদের অনেক আগে যারা এই শহরে ছিলেন, তাঁরা কেমন ছিলেন? কেমন ছিল তাঁদের সামাজিক মূল্যবোধ, কেমন ছিল তাঁদের রুচি, অভ্যাস কিংবা সংস্কৃতি? এ সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পুরনো সে সব স্থাপনা। একটা সমাজকে জানতে বুঝতে শিখতে যে কয়টা উপাদান অনেক বেশি জরুরী, সম্ভবত আর্কিটেকচার সে গুলোর মধ্যে একদম উপরের দিকেই থাকবে।
স্থাপত্য বা আর্কিটেকচারের গুরুত্ব
আর্কিটেকচার বা স্থাপত্যের আসল কাজ হচ্ছে মানুষের বসবাসের জন্য একটা পরিবেশ তৈরি করা। তবে আর্কিটেকচার শুধু পরিবেশেই সীমাবদ্ধ নয়, এটা আমাদের সংস্কৃতিরও একটি অংশ। আমরা কীভাবে নিজেদের দেখি, সেই সাথে আমরা কীভাবে গোটা বিশ্বকে দেখি: আর্কিটেকচার সেটারই প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে যুগের পর যুগ। মানুষ মারা যায়, চলে যায় প্রজন্ম, থেকে যায় চিন্তা, সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ; থেকে যায় স্থাপনায় গাঁথা প্রতিটি ইটে।
একটা আর্কিটেকচারের প্রধান কাজ হচ্ছে মানুষের আশ্রয় নিশ্চিত করা। আপনি খোলা চোখে দেখছেন একটা স্ট্রাকচার তৈরিতে ইট, বালি, সিমেন্ট, রড লাগে। আপনার ধারণা ভুল না। কিন্তু এটাও সত্য যে, কোন ভবন তৈরির পেছনে আরও থাকে ঐ স্থানের জলবায়ু, উপকরণের সহজলভ্যতা এবং ঐ সমাজের মূল্যবোধ। পৃথিবী যত ছোট হয়েছে, আর্কিটেকচার তত বিকশিত হয়েছে। এখনকার আধুনিক যুগে কালচারাল ডিফারেন্স কমে এসেছে। এই সময়ে এসেও পরিবেশ এবং কালচারাল যে সূক্ষ্ম তফাৎ আছে সেটা ফুটিয়ে তুলতে আর্কিটেকচার অসীম গুরুত্ব বহন করে।
এই কারণেই বৃহত্তর বরিশালে কাঠের দোতলা বাড়ি আজও মানুষ দেদারসে বানিয়ে যাচ্ছে। আবার উত্তরবঙ্গে মাটির ঘর তৈরি হচ্ছে সবসময় অর্থাভাবে নয়, বরং পরিবেশের সাথে খাপ খাইতে নিতে। এই বাড়িগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিন্ত আর্কিটেক্টরা করছেন না। করছেন স্থানীয় মানুষরা তাঁদের বসবাসের প্রয়োজন মেটাতেই। কিন্তু আর্কিটেকচারের মূল্যায়ন কি তাঁরাও বুঝে না বুঝে করছেন না?

এখনো আর্কিটেক্টরা প্রতিদিন চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজের সীমাবদ্ধতা ভেঙে বাউন্ডারি আরও দূরে নিয়ে যেতে। চেষ্টা করছেন শিল্প এবং ডিসিপ্লিন হিসেবে আর্কিটেকচার পেশার প্র্যাকটিসকে নতুন মাত্রা দিতে।
আর্কিটেকচার মানেই একটা বিল্ডিং এর চেয়েও বেশি কিছু
আর্কিটেকচার শুধু একটা সমাজকে শুধু প্রভাবিত করে এমন না, বরং প্রভাবিত করে ব্যক্তি জীবনেও। একটা বাড়িতে বসবাসকারীদের ওপর আর্কিটেকচারের প্রভাব গভীর। বাড়িটার ডিজাইন কেমন, কি ধরণের ম্যাটেরিয়ালসে সেই বাড়ি তৈরি হচ্ছে: এই সবকিছুই তাঁর স্বাস্থ্য, মেজাজ এবং প্রোডাক্টিভিটির উপর অনেক অবদান রাখে। দেখা গেছে, যাদের অফিসের ডিজাইনটা চমৎকার, তারা অসুস্থতাজনিত ছুটি নেন অনেক কম, অনেক বেশি মনোযোগী থাকেন এবং সাধারণত অফিসে তাঁদের প্রোডাক্টিভিটিও অনেক বেশি থাকে।
উঁচু উঁচু বিল্ডিং এবং কংক্রিট ল্যান্ডস্কেপ মানুষের স্ট্রেস বাড়ায়। যেহেতু এটার কোন বিকল্প নেই তাই বিল্ডিংগুলির পাশাপাশি সেই শহরকে এমনভাবে ডিজাইন করা উচিৎ যেন সেটা মানুষের মনকে হালকা করে, করে স্নিগ্ধ, মানুষকে আনন্দ দেয়। এইসব কিছু নিয়েই তো আর্কিটেকচার!
ধরুন প্রতিদিন যখন আপনার মন খারাপ হয়, আপনি ঘরের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে নিজেকে সময় দেন। হুট করে এই জিনিসটার গুরুত্ব বিশেষ কিছু বলে মনে হবে না। কিন্তু আপনার কাছে এই জায়গাটার এবং ঐ সময়টার গুরুত্ব হয়ত টাকার চেয়েও বেশি। হয়ত ঐ নিজেকে দেয়া সময়টা আপনাকে বাকি দিনটা এগিয়ে যাওয়ার রসদ যোগায়।
আর্কিটেক্ট হিসেবে কোন একটা ফাংশনের বা প্রয়োজনের জন্য ডিজাইন করা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ সেই ফাংশনের সাথে মানসিক সংযোগ ট্যাপ করা। কারণ দুটোই আর্কিটেকচারের জন্য সমান জরুরী। তাই আর্কিটেকচার শুধুমাত্র একটি বুদ্ধিবৃত্তিক বোঝাপড়া নয়, মানুষ এবং একটা জায়গার মধ্যে ইমোশনাল এটাচমেন্ট তৈরির সুযোগও বটে।
আর্কিটেক্টের ভূমিকা
ইন্টারনেটে এখন সবার অবাধ বিচরণ। বিশ্বের যে কোনও জায়গায় যে কোন মানুষের সাথে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ করার ক্ষমতা আর্কিটেক্টদের প্র্যাকটিসে বিশাল পরিবর্তন এনেছে। আর্কিটেক্টরা আরেক মহাদেশের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করতে পারেন এবং সারা পৃথিবীর আর্কিটেক্টদের সাথে কোলাবোরেশন করতে পারেন। এই কোলাবরেশন উন্মুক্ত করেছে কালচারাল ফিউশন। টেকনোলোজি আমাদের ডিজাইন করার পদ্ধতিতেও এনেছে পরিবর্তন। বিআইএম মডেলিং, থ্রি ডি মডেলিং, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি দৃষ্টি ও বাস্তবতার মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। যে কোন প্রজেক্ট এখন সাইটে যাওয়ার আগেই চোখে দেখা যাচ্ছে। এই পরিবর্তন পুরো প্র্যাকটিসটাই বদলে দিয়েছে।

প্রযুক্তির এই প্রভাব সামনে আরও বাড়বে। কিন্তু একইসাথে বাড়বে চ্যালেঞ্জ। উদাহরণস্বরূপ,
- কীভাবে আমরা শহরগুলির মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে ব্যবধানকে মোকাবেলা করব?
- কিভাবে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রিফিউজি ক্রাইসিস নিয়ে আর্কিটেকচারে কাজ করব?
- আমরা কীভাবে বিশ্বের জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধির সাথে লড়াই করব?
- আমাদের শহরগুলিকে প্রাকৃতিক পরিবেশের অভাবকে কীভাবে আমরা ডিজাইনের মাধ্যমে সমাধান করব?
সবশেষে বলতে চাই, আর্কিটেকচার আসলে মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং আরও অনেক কিছুর উপর নির্ভরশীল। ঢাকা ডিজাইনারস এ, আমাদের ডিজাইন প্র্যাকটিসটা আসলে ক্লায়েন্ট এবং আমাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া তৈরির চেষ্টা।