প্রশ্নটা খুব ই জটিল। আপনি যখন একজন ডাক্তার দেখাবেন ঠিক করেন, তখন ঐ ডাক্তারের কিছু পেশেন্ট বলবে, “ভাই ডাক্তার একদম ভালো না। টাইম দেয় না, আমি আমার প্রবলেমের কথা বলার সময় উনি মোবাইল টিপতেসিল। পুরাপুরি না শুনেই ১০ টা টেস্ট দিয়া দিল। আরও আট হাজার টাকার ধাক্কা। দেখেন তো অবস্থা!” একই ডাক্তার দেখায়ে এসে আরেকজন বলবে, “ভাই ডাক্তার খুবই ভালো। এর আগে ৩ ডাক্তার দেখায়েও আমার কোন লাভ হয় নাই। উনার দেয়া ওষুধ দুই সপ্তাহ খাওয়ার পর এখন ভালো আছি।” ভাবছেন আর্কিটেক্ট এর সাথে ডাক্তারের সম্পর্ক কি? সম্পর্ক আছে। যে কোন পেশাতেই আপনি যখন কারো প্রফেশনাল সার্ভিস নেবেন, তখন সে কেমন সার্ভিস দিচ্ছে সেটার পাশাপাশি আপনি সঠিক জায়গায় গেছেন কি না সেটা জানাও জরুরী। আপনার হাড্ডির সমস্যায় যদি হার্টের স্পেশালিষ্টের কাছে যান, আপনি কিন্তু সঠিক সার্ভিসটা পাবেন না। আর্কিটেকচার ও এর ব্যতিক্রম না। তবে অবশ্যই এর পাশাপাশি একজন আর্কিটেক্ট কেমন সেটা বিচার করার আরও কিছু প্যারামিটার তো আছেই। তো আজকে সেগুলো নিয়েই কথা বলব।

কষ্টের টাকায় বাড়ি বানাবেন, সঠিক আর্কিটেক্ট এর হাতে দায়িত্ব তুলে দেয়াটা তো সবচেয়ে জরুরী!

১। আর্কিটেক্ট মানুষ হিসেবে কেমন

আর্কিটেক্টদের বিরাট একটা অংশ ভাব-গম্ভীর এবং অ-মিশুক। সহজ কথায়, আর্কিটেক্টদের বেশিরভাগ ইন্ট্রোভার্ট। তাঁরা ব্যবসায়ীদের মত মিষ্টি করে কথা বলতে পারেন না। বাচ্চাদের ডাক্তারদের মত তাঁদের মুখে সবসময় হাসি দেখা যায় না। সাধারণ দৃষ্টিতে এই ধরণের মানুষের সাথে কাজ করাটা কিন্তু একটু কঠিন ই। একটা কন্সট্রাকশন বেশ লম্বা সময়ের কাজ। এই পুরোটা সময় আপনি আপনার আর্কিটেক্ট এর সাথে রেগুলার টাচে থাকবেন। তাই আপনাকে শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আপনি হাসিখুশি আড্ডাবাজ নাকি লাজুক আর ইন্ট্রোভার্ট কারো সাথে কাজ করতে চান। তবে খেয়াল রাখা উচিৎ, একজন মানুষ ইন্ট্রোভার্ট না এক্সট্রোভার্ট এটার ওপর তাকে পছন্দ বা অপছন্দ করাটা ঠিক হবে না।

২। আর্কিটেক্ট হিসেবে কেমন, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ!

আর্কিটেক্ট হিসেবে উনি কেমন, সেটা কিভাবে বুঝবেন? এটার জন্য মূলত দুটো দিক আপনাকে দেখতে হবে।

প্রথমটা হচ্ছে, একাডেমিক কুয়ালিফিকেশন বা উনি কোথায় এবং কি ধরণের পড়াশোনা করেছেন।

  • উনি কি ডিপ্লোমা নাকি ব্যাচেলর করা?
  • উনি কি মাস্টার্স করেছেন?
  • এওয়ার্ড পেয়েছেন কোন?

অনেকেই মনে করে একাডেমিক কোয়ালিটি গুরুত্বপূর্ণ না। কথাটা ঠিক না। একাডেমিক কুয়ালিফিকেশন একজন আর্কিটেক্ট এর ফাউন্ডেশন তৈরি করে। অনেকেই একাডেমিক পর্যায়ে খারাপ করেও পরে অনেক ভালো প্রোজেক্ট তৈরি করতে পারেন। কিন্তু যাদের একাডেমিক কুয়ালিফিকেশন ভালো, তাঁদের আর্কিটেকচার বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতা এবং প্যাশন নিয়ে একটা নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। এই নিশ্চয়তা আপনাকে আপনার আর্কিটেক্ট এর ব্যাপারে কনফিডেন্স দেবে। আর আপনার স্বপ্নের বাড়ি বানানোর দায়িত্ব আপনি যার হাতে দেবেন, তাঁর উপর আপনার কনফিডেন্স থাকাটা তো খুবই জরুরী, না কি?

দ্বিতীয়টা অভিজ্ঞতা। উনি কত বছর ধরে ডিজাইন বা কনসালটেন্সি’র সাথে জড়িত। আর্কিটেক্ট যত বেশি অভিজ্ঞ, সে আর্কিটেক্ট হিসেবে তত ভালো। সেই সাথে অবশ্য তাঁর ফি-টাও তত ভালো মানে বাড়তে থাকবে। তাই একাডেমিক কুয়ালিফিকেশন আর অভিজ্ঞতা: এই দুই-এর ব্যালেন্স আপনাকে বের করতে হবে। ব্যালেন্স বের করতে আপনাকে হেল্প করবে আপনার বাজেট।

বেকার ফুড প্রডাক্টসএর জন্য ঢাকা ডিজাইনারের ডিজাইন করা চকলেট ফ্যাক্টরি, ভুলতা’য় অবস্থিত

৩। আর্কিটেক্ট বা তাঁর ফার্ম কি ধরণের প্রোজেক্ট করেন?

যে আর্কিটেক্ট যে ধরণের কাজ বেশি করেন, স্বাভাবিকভাবেই সেই কাজে তাঁর এক্সপার্টিজ তত বেশি হয়। তাই আপনার কাজের জন্য ঐ আর্কিটেক্ট পারফেক্ট ফিট কি না সেটা বিবেচনার জন্য উনি বা উনার ফার্ম কোন ধরণের কাজ বেশি করেন, সেটা জানা জরুরি। যারা মূলত ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়ে কাজ করেন, তারা আপনার হসপিটালের বিল্ডিং ডিজাইনের জন্য সঠিক আর্কিটেক্ট না ও হতে পারেন। কিন্তু উনি ই আপনার হসপিটালের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের জন্য হতে পারেন পারফেক্ট চয়েস।

৪। আর্কিটেক্ট এর অফিস সেটআপ কেমন?

অফিস সেটআপ মানে আর্কিটেক্ট এর অফিস কতটা সুন্দর, সেটা কিন্তু না। আর্কিটেক্টরা নানানভাবে প্র্যাকটিস করেন। কেউ একা একাই সব কাজ করেন; ফ্রিল্যান্সারদের মত। দেখা যায় এ ধরণের আর্কিটেক্টরা সব কাজ আউট-সোর্স করে দেন, শুধু বেসিক ডিজাইনটা নিজে করেন। এসব ক্ষেত্রে অনেকাংশেই তাঁদের কাজ ডেলিভারি দিতে সময় বেশি লাগে। আবার যেহেতু নিজেই সব কাজ করছেন, তাই কাজের কোয়ালিটি বেশ ভালো হয়। তবে একা কাজ করার কারণে খুব বেশি প্রজেক্ট তাঁরা করতে পারেন না। আপনার বুঝতে হবে আপনার কাছে কোনটার প্রায়োরিটি বেশি? কোয়ালিটি না ডেডলাইন। এটার একটা ব্যালেন্স করতে পারাটা খুবই জরুরী।

এরপর আছে পার্টনারশিপ ফার্ম। এ ক্ষেত্রে তিন-চারজন বন্ধু বা আর্কিটেক্ট মিলে একটি ফার্ম চালান। এটাই সবচেয়ে পপুলার প্র্যাকটিস। পার্টনারদের সবাই আর্কিটেক্ট হতেও পারেন, না ও পারেন। তবে, অনেকগুলো মেধাবী মানুষ একসাথে থাকায় তাঁরা অনেক কাজ নিতে পারেন এবং মোটামোটি সময়মত কাজ শেষ ও করতে পারেন।

একদল মেধাবী আর্কিটেক্ট নিয়ে নানা প্রান্তে গড়ে উঠছে বেশ কিছু পার্টনারশিপ ফার্ম

আর সব শেষে আছে লিমিটেড কোম্পানি অথবা বড় আকারের প্রোপ্রাইটারশিপ। এটা আসলে আর দশটা কোম্পানির মত বড় প্রতিষ্ঠান । আমাদের দেশে পার্টনারশিপ ফার্মগুলো প্রায়ই ভেঙ্গে যায়। আপনার তিন বা পাঁচ বছর মেয়াদি প্রোজেক্ট চলতে চলতেই দেখবেন, কখনো কখনো একটা কোম্পানি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এসব ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্য লিমিটেড কোম্পানি ভালো। এখানে চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছাড়াও থাকেন বেশ কিছু ইনভেস্টর এবং স্টেকহোল্ডার। আপনি যদি কন্সট্রাকশন রিলেটেড বিভিন্ন সার্ভিস চান, আর সেই সাথে চান কম দামে ম্যাটেরিয়াল সোর্সিং; তাহলে লিমিটেড কোম্পানিগুলো এই ব্যাপারে বেশ ভালো সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। ব্যাংক লোণ বলেন বা বড় অংকের ট্র্যানজেকশন: লিমিটেড কোম্পানি আপনার জন্য সবচেয়ে সেইফ। তবে লিমিটেড কোম্পানির সবচেয়ে বড় নেগেটিভ দিক হচ্ছে এর প্রাইসিং। বড় কোম্পানিতে প্রাইসিং খুব একটা কম্প্রোমাইজ করা সম্ভব হয়না। কারণ এখানে আর্কিটেক্ট ছাড়াও নানান ধরণের মানুষ জড়িত থাকে। তাই সময়ের সাথে “না” করে দেয়া প্রজেক্টের সংখ্যাও বাড়তে থাকে।

এখন আপনি ই বলুন, আপনার চোখে ভালো আর্কিটেক্ট কে? আসলে আপনার জন্য ভালো আর্কিটেক্ট সে ই, যে আপনার বাজেট আর আপনার প্রোজেক্টের মধ্যে একটা সুন্দর ব্যালেন্স করে আপনাকে সবচেয়ে ভালো আউটপুট দিতে পারবেন।

এরপর ও যে কোন প্রয়োজনে বা কনফিউশন দূর করতে প্রফেশনালদের সাহায্য নিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *