ঘড় ছেড়ে রোজ বের হচ্ছন। উদ্দেশ্য: জীবন ও জীবিকা। এরপর সারাদিন ছুটোছুটি, ক্লান্তি। রাতে ফিরে আসছেন নিজের ঘর। নিজের একটা জগত; একদম একান্ত নিজের। সেখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে একটা জিনিস। আপনার খাট। হ্যাঁ, আপনার খাট আপনার জন্য এতটাই জরুরী। ঠিক যেন খাট ছেড়ে উঠে আবার খাটে ফিরে আসাই রোজকার রোজনামচা!

প্রতিদিন একজন মানুষ গড়ে ৮ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটায়। এই ৮ ঘণ্টা তাঁর শরীরের একটা অংশ: তাঁর খাট। আপনার জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ মানে ৩৩% কাটছে যে খাটে, সেটা নিয়ে ভাবনার দরকার আছে কি নেই? আছে তো, থাকতেই হবে। এক মেরিন অফিসার একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন:

প্রতিদিন সকালে উঠে প্রথমেই নিজের বিছানাটা মানে খাটটা গুছিয়ে ফেলুন। এর মানে আপনি দিনটা গুছিয়ে শুরু করছেন। পুরোটা দিনের জন্য এই গুছানো আপনাকে একটা সুন্দর সূচনা এনে দেবে। সারাটা দিন যখনই আপনি ক্লান্তিতে, বিরক্তিতে, পরিশ্রমে ভেঙে পরতে যাবেন, আপনার মনে পড়বে ঘরে একটা গোছানো বিছানা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

তাই সেই খাট নিয়েই আজকে আমাদের এই আলাপ। খাটনামা: ৩৩% জীবনের গল্প। কেমন হওয়া উচিৎ আমার খাট? কি মাপ হওয়া উচিৎ? কার জন্য কেমন খাট রাখা দরকার? বাচ্চা, বুড়ো সবার খাট কি একই হবে? কতটা সময় দেব এই খাট সিলেকশনের পেছনে?

খাটের মাপগুলো প্রায়ই আমাদের কনফিউজড করে ফেলে। খাটের হাইট কত হয়, বা কত হওয়া উচিত! আবার চওড়ায় কত হয় বা হওয়া উচিত: সেগুলো আপাতদৃষ্টিতে খুবই তুচ্ছ ব্যাপার মনে হতে পারে। কিন্তু বাধ সাধবে যখন বিছানায় যাবেন। হাজার হোক যেখানে জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ সময় কাটাবেন, সেটা নিয়ে একটু মাথা না খাটালে চলে? সহজ ভাষায় আমাদের দেশে খাট মূলত দুইরকম: ১। সিঙ্গেল বা একা ঘুমানোর খাট ২। ডাবল বা দুইজন ঘুমানোর খাট

তবে বাংলাদেশে বাচ্চা-কাচ্চারা ৩-৪ বছর বয়স পর্যন্ত বাবা-মার সাথেই ঘুমিয়ে অভ্যস্ত। পিঠাপিঠি বাচ্চাদের বেলায় অনেক সময় এক খাটে ৪ জন পর্যন্ত ঘুমোতে হয়। এছাড়াও আরও এক ধরণের খাট আছে যেটাকে ব্যাংক বেড বলে। সেটা নিয়েও আলাপ করব। খাট দেখতে কি রকম হবে সেটার উপরে দুইভাগে ভাগ করা যায়

১। বক্স-খাট:

এই খাটগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে খাটের নিচটা বক্স দিয়ে আটকানো থাকে। এখন এই বক্সের ভিতরে কিছু না-ও থাকতে পারে, অথবা ড্রয়ার থাকতে পারে, অথবা অটোম্যান স্টাইলে পুরো বিছানাটাই উপরে উঠে গিয়ে নিচের পুরোটাতেই স্টোরেজ থাকতে পারে।

সাধারণ বক্স খাট। ভিতরটা ফাঁকা
বক্স খাট , ড্রয়ার সহ
অটোম্যান খাট, এই মেকানিজমটা আলাদা করে কিনতে হয়

২। ফ্রেমওয়ালা খাট বা স্ট্যান্ডার্ড বেড:

আমরা সচরাচর যেই বেডগুলো দেখি, নিচের দিকটা ফাকা থাকে, সেগুলোই এই ফ্রেম-ওয়ালা খাট। কখনো এই ফ্রেম অনেক মিনিমাল হতে পারে আবার অনেক মোটাও হতে পারে। ডিজাইনের দিক থেকে মডার্ন হতে পারে, যেটায় কোন নকশা থাকেনা। আবার অনেক ক্লাসিকাল হতে পারে, যেমন ফুল-ফল আঁকা। কখনো কখনো মশারি টানানোর জন্য পোষ্ট বা স্ট্যান্ড সহ ডিজাইন পাওয়া যায়। তবে এখন সবাই ডিজাইন বিহীন খাটগুলোই বেশি পছন্দ করে। এ ধরণের খাট পছন্দের আরেকটি কারণ হচ্ছে নিচের দিকটা খুব সহজে পরিষ্কার করা যায়।

কালজয়ী ডিজাইনের একটি মিড সেঞ্চুরি মডার্ণ খাট
ক্ল্যাসিকাল ডিজাইনের ফ্রেঞ্চ খাট
নর্ডিক স্টাইলের খাট। খুব ই সিম্পল এই ডিজাইনগুলো IKEA তে অনেক দেখা যায়, সাদা বা উড কালারে

বক্স খাট এবং ফ্রেমড খাট দুটোই বিভিন্ন সাইজের হয়। খাট কি রকম বা কোন সাইজের বানাবেন তা আসলে পুরোপুরি আপনার চাহিদা ও রুচির ব্যাপার। তবে যা-ই করেন না কেন, খাটের উচ্চতা হবে ১৮-২০ ইঞ্চি। এই হাইট হবে ফ্লোর থেকে আপনার ম্যাট্রেস এর টপ পর্যন্ত।

তবে অনেকেই অনেক মোটা আর নরম ম্যাট্রেস ব্যবহার করতে চান, সেক্ষেত্রে ম্যাট্রেসের উপরে বসার পরে সেই হাটটা ১৮-২০ ইঞ্চির ভিতরে আসতে হবে। আবার ব্যক্তিগতভাবে কেউ চাইলে এটাকে কিছুটা উঁচু বা নিচু করতে পারেন।

খাট কতটা লম্বা বা চওড়া হবে, সেটা আপনি ম্যাট্রেসের কথা চিন্তা করেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। চাইলে সহজেই ম্যাট্রেসগুলো কাস্টোমাইজ করে বানিয়ে নিতে পারবেন। এখন অনেক ওয়েবসাইট আছে যেখানে আপনি ম্যাট্রেসের মাপ দিলেই দাম বলে দেয়। যেমন এখানে ক্লিক করে ম্যাট্রেসের মাপ দিয়ে প্রাইস রেঞ্জ দেখে নিতে পারবেন।

তবে সাধারণভাবে খাটের কিছু স্ট্যান্ডার্ড সাইজ কিন্তু আছে । সেই স্ট্যান্ডার্ড সাইজগুলো নিচে দেওয়া হলো :

নংবেডের নাম বা টাইপলম্বা – চওড়া – উচ্চতা (ইঞ্চিতে দেয়া)
০১সিঙ্গেল বেড৮৪ – ৩৬ – ১৮ (বাচ্চাদের বেড হলে লম্বায় ৭২ হতে পারে)
০২ডাবল বেড৮৪-৫৪-১৮ (সবচেয়ে ইকোনমিক সাইজ এটা)
০৩কুইন বেড৮৪-৬০-১৮ (বহুল প্রচলিত সাইজ। দেশের ৯০% বেড এটাই)
০৪কিং বেড৮৪-৭২-১৮ (বাজারে যেমন ডিসিসি মার্কেটে আবার ৬৬” চওড়া পাওয়া যায়)
০৫বড় কিং বেড৯৬-৮৪-২২ (অনেকের বেডরুম অনেক বড় হয়, আর অনেকেই খাটে যে দিকে ইচ্ছা ঘুমাতে চান, তাদের জন্য এই সাইজ পার্ফেক্ট)

৩। বাংক খাট:

একটা খাটের ওপরে আরেকটা খাট দিয়ে ব্যাংক খাট বানানো হয়। সাধারণত জায়গার স্বল্পতা বা রুমের সংখ্যা কম থাকলে এই বেডগুলো ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও কাছাকাছি বয়সের ছোট দুই বাচ্চা থাকলে তাদের জন্য এরকম বেড দেয়া যেতে পারে। মেটাল বা বোর্ড দুই-রকমভাবেই এই বেড বাজারে পাওয়া যায়।

IKEA-র একটা বাংক খাট। এটার নিচের স্পেইসে এভাবে অর্গানাইজার দিয়ে বা ড্রয়ার দিয়ে স্টোরেজ আড করা যেতে পারে
বেশি কমপ্যাক্ট করতে চাইলে তিনটাও করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে একেবারে নিচের খাটটা ফ্লোরের সাথেই লেগে থাকবে

এখন আসি খাট কিভাবে বানানো যেতে পারে। আপনার রুম যদি প্রশস্ত হয় তাহলে রেডিমেড বাজার থেকে কিনে এনে বসিয়ে দিতে পারেন। বেড বা খাটকে রুমের কোনদিকে কিভাবে বসালে সবচেয়ে ভাল হয়, সেটা নিয়ে আলাদা আলোচনা হতে পারে। খাট বিক্রি করে এরকম কোম্পানিগুলোর মধ্যে কয়েকটি হল:

  • হাতিল
  • রিগ্যাল ফার্নিচার
  • পারটেক্স ফার্নিচার
  • ইশো
  • অটোবি
  • ব্রাদার্স ফার্নিচার
  • আখতার ফার্নিচার

এছাড়াও ডিসিসি মার্কেটগুলো, মিরপুর দশ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত রাস্তার পাশে অনেক ফার্নিচারের দোকান আছে। কোয়ালিটি এবং রুচির উপর নির্ভর করে রেডিমেড ফার্নিচারগুলো থেকে একটা পছন্দ করে নেয়াটাই আসলে সবচেয়ে ভালো। কারণ এক: কোয়ালিটি নিয়ে চিন্তা থাকেনা, দুই: দেখতে কেমন হবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকেনা এবং তিন: সময় বাঁচে।

আপনার বাসার রুম সাইজ যদি একটু ছোট বা অন্যরকম হয়, অথবা আপনার পছন্দ এবং রুচি অনুযায়ী যদি বাজারে খাট খুঁজে না পান, তাহলে দুটো উপায় আছে: এক: ইন্টারনেট থেকে ড্রইং এবং ডাইমেনশান সহ খাট পছন্দ করে মিস্ত্রিদের দিয়ে বানিয়ে নেয়া দুই: কোন ডিজাইন ফার্মের মাধ্যমে ডিজাইন করিয়ে তারপরে তাঁদের দিয়েই বানিয়ে নেয়া।

অনেকেই হাতে ছবি প্রিন্ট করে দোকানে দোকানে ঘুরে পছন্দের খাট বানাতে চান। এটা করবেন না। কারণ হুট করে নতুন একটা ডিজাইন কেউ ই বানাতে পারবেনা। পারলেও অসংখ্য ভুল হবে খুব স্বাভাবিকভাবেই। খাট যারা তৈরি করেন, একই ডিজাইনের খাট বানাতে বানাতে একসময় তাঁদের পারফেকশনে আসে।

নতুন একটা ডিজাইনের সাথে যদি কিভাবে বানাতে হবে তার বিস্তারিত ডিরেকশান দেয়া না হয়, তাহলে সেটা পারফেক্ট হওয়া অসম্ভব। এই দিক থেকে IKEA এর মত ওয়েবসাইটগুলো আপনার অনেক কাজে আসতে পারে। তাদের সবগুলো ডিজাইনেরই মাপ সহ ড্রইং দেয়া থাকে। আইডিয়ার জন্য দেখে নিতে পারেন।

শেষ কথা, খাট বিষয়ে আপনি দুইভাবে চিন্তা করতে পারেন। এক: এমন দাম এবং ম্যাটেরিয়াল দিয়ে বানাবেন, যেটা আপনি এবং আপনার নাতি নাতনি সহ আগামী দুইশ বছর ব্যবহার করা হবে। দুই: তুলনামূলক কম দাম দিয়ে বানানো যেন রুচি ও চাহিদার পরিবর্তনে নতুন আরেকটা খাট আপনার বাসায় আসে। তাছাড়া বাসা পরিবর্তন করার সময় খাট হালকা এবং সহজে খুলে ফেলার ব্যবস্থা থাকলে আরও ভালো হয়।

তাই ভেবে-চিন্তে খাট বাছুন, খাট কিনুন। জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ যেখানে কাটাবেন, সেটা নিয়ে না ভাবলে ভাববেন টা কি নিয়ে শুনি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *