আপনার নিজের একটা জমি আছে কিংবা আপনাদের কয়েকজন মিলে একটা জমি কিনেছেন বেশ আগে। স্বপ্ন একটা বাড়ি করবেন। মাথার উপর একটা ছাদ মানুষের সভ্যতার শুরু থেকেই চাহিদা। সভ্যতা বদলেছে, চাহিদা এক থাকলেও বদলায় স্বপ্ন। নিজের একটা বাড়ি: এই স্বপ্ন কার নেই? নিজের একটা বাসা, সেই বাসাতে সন্তানদের বেড়ে ওঠা, নিজের স্ত্রীর ঘরণী হয়ে ওঠা: এসব কিছু নিয়েই ছোট্ট একটা জীবন আমাদের। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল তাঁর পরিবার। আর একটা পরিবারের আবাস হচ্ছে একটা বাসা। নিজের ঘর, নিজের সংসার, নিজের একটা বাড়ি। সেই বাড়ি আপনি বানাবেন। কিন্তু কে বানিয়ে দেবে এই বাড়ি? কার কাছে যাব? কাছের মানুষদের কেউ বলে আর্কিটেক্ট এর কাছে যাও। কেউ বলে ইঞ্জিনিয়ার খোঁজো! আসলে বাড়িটা বানাবে কে? আর্কিটেক্ট আর ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে কার কাছে যাব আমি? এঁদের মধ্যে তফাৎ টা কি?

আপনার বাড়িটা বানানোর জন্য এই দু’জন ই সমান জরুরী। আপনাকে দুজনের সাথেই কাজ করতে হবে। এরা দুজন মিলে আপনাকে গড়ে দেবে আপনার বাড়ি। তাহলে এঁদের কার কাজ কি? একদম স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা করলে, আর্কিটেক্ট বাড়ির ডিজাইন করেন এবং একজন ইঞ্জিনিয়ার সেটার স্ট্রাকচারাল বিষয়টা দেখেন মানে বাড়িটা তৈরি করেন। এবং এই দুজন একেবারে শুরু থেকেই কোলাবোরেশনে কাজ করেন। আরেকটু ভালোভাবে বুঝার জন্য চলুন চটজলদি দেখে নেই আর্কিটেক্ট আর ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে কার কাজ আসলে কি!

আর্কিটেক্ট

  • আর্কিটেক্ট এর বাংলা হল স্থপতি। একজন আর্কিটেক্ট পাঁচ বছর মেয়াদি অনার্স কোর্স করেন যার ডিগ্রীর নাম ব্যাচেলর অফ আর্কিটেকচার ( B.Arch)। খেয়াল করবেন তারা কিন্তু B.Sc ডিগ্রি ধারণ করেন না। তারা ইঞ্জিনিয়ার নন। অনেকেই আর্কিটেক্টদের ইঞ্জিনিয়ার বলেন, যেটা একদম ভুল।
  • অনার্স পাশ করার পর তারা IAB (Institute of Architects, Bangladesh) এর মেম্বার হন। তখন তাঁদের আর্কিটেক্ট বলা হয়।
  • আর্কিটেক্টদের IAB মেম্বার-শিপ থাকে যা এই সাইটে গিয়ে ভ্যারিফাই করা যায়। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে অনেকেই ভুয়া পরিচয় দিয়ে বিল্ডিং ডিজাইন করে থাকেন যারা অনেকেই আর্কিটেক্ট নন। তাই এই বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে।
  • ডিপ্লোমা আর্কিটেক্টরা IAB’র মেম্বার নন। তবে তারা তাঁদের সীমার ভিতরে ডিজাইন করতে পারবেন যে বিষয়ে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। ডিপ্লোমা আর্কিটেক্ট, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আর আর্কিটেক্ট, আপনার বিল্ডিং এর ডিজাইন কে করবে?
  • একজন আর্কিটেক্ট আপনার বিল্ডিং এর নান্দনিক এবং ফাংশনাল দিকগুলো দেখেন।
  • একজন আর্কিটেক্ট আপনার জমি এবং বাড়ির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করেন।
  • আপনার বাড়িতে আলো বাতাসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করাটাও আর্কিটেক্ট এর দায়িত্ব।
  • আপনার বাড়িতে সিকিউরিটি এবং প্রাইভেসি নিশ্চিত করতে আর্কিটেক্ট ডিজাইন করার সময় খেয়াল রাখেন।
  • প্রতিটা রুমের সাইজ এবং অবস্থান ঠিক করাটাও আর্কিটেক্ট এর ই কাজ।
  • সর্বোপরি একজন আর্কিটেক্ট আপনার বাড়ির সৌন্দর্যের বিষয়টি দেখেন । বাড়িটি দেখতে কেমন হবে, কি রং থাকবে, কি ধরণের ম্যাটেরিয়ালে বাড়িটা তৈরি হবে, আলো বাতাস কোথা দিয়ে ঢুকবে, আপনি বাড়িটা কতটা নান্দনিক আর রুচিশীল ভাবে তৈরি করবেন, এসব কিছু আর্কিটেক্ট এর মাথা ব্যথা।
আর্কিটেক্ট এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের মাঝে অনেক বিষয়ে মিল এবং অমিল আছে

সিভিল ইঞ্জিনিয়ার

একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের কাজের জায়গা মূলত ৫টি:

  • স্ট্রাকচার অর্থাৎ বিল্ডিং।
  • ওয়াটার রিসোর্স অর্থাৎ নদী, খাল, সমুদ্র ইত্যাদি।
  • জিওটেক অর্থাৎ মাটি যেটা যে কোন স্ট্রাকচার তোলার সময়ই অবশ্যই দরকার হয়।
  • ট্রান্সপোর্টেশন অর্থাৎ রাস্তা, ফ্লাইওভার, ব্রিজ ইত্যাদি।
  • এনভায়রনমেন্ট অর্থাৎ পরিবেশ।

এর মধ্যে একটা অংশ হচ্ছে স্ট্রাকচার যেটা আপনার বিল্ডিং ডিজাইন নিয়ে কাজ করে। এই ডিজাইন শব্দটা নিয়েই বেশিরভাগ মানুষ কনফিউজড হয়। আর্কিটেক্ট এর ডিজাইন আর ইঞ্জিনিয়ারের ডিজাইন এক না। আর্কিটেক্ট বাড়ির লুক বা চেহারা ডিজাইন করেন। সেই চেহারা বাড়ির ভেতর এবং বাইরের দুটোই। ইঞ্জিনিয়ার ডিজাইন করেন বাড়ির কংকাল অর্থাৎ বাড়ির কলাম, বিম, স্ল্যাব এসব। মানে আর্কিটেক্ট এর দেয়া শরীরটা ঠিকভাবে দাঁড় করানোর ডিজাইনের দায়িত্ব থাকে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের ওপর। চলুন জেনে নেয়া যাক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে আরও কিছু জরুরী তথ্য।

  • ইঞ্জিনিয়ার মানে প্রকৌশলী। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মানে পুরকৌশলী।
  • একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার চার বছর মেয়াদি অনার্স ডিগ্রি নেন যার নাম B.Sc in Civil Engineering
  • অনার্স পাশ করার পর তারা IEB ( Institute of Engineers, Bangladesh) এর মেম্বার হন।
  • প্রত্যেক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের IEB মেম্বার-শিপ নাম্বার আছে যা এখানে গিয়ে আপনি যাচাই করে দেখতে পারবেন।
  • একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এবং IEB’র মেম্বার ইঞ্জিনিয়ারদের কাজের পরিধি ও ক্ষমতার পার্থক্য আছে। তাই তাঁদের কাজের এবং দক্ষতার ক্ষেত্রগুলো জেনে নিন।
  • একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বিল্ডিং এর ইঞ্জিনিয়ারিং এবং স্ট্রাকচারাল বিষয়গুলো দেখেন।
  • বাড়ি মজবুত কতটুকু হবে এবং ভূমিকম্প সহনশীলতা নিশ্চিত করা একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব।
  • কি ধরণের রড, কতটুকু কোথায় দিতে হবে: এই ডিজাইন করবেন একজন ইঞ্জিনিয়ার।
  • আপনার বিল্ডিং এর ফর্মা এবং কংক্রিটের ডিজাইন করেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।
  • আপনার বাড়ির কলামের ডিজাইন এবং স্পেসিং নির্ধারণ করেন এবং আর্কিটেক্ট এর সাথে এই বিষয়ে কোলাবরেশনও করেন তিনি।
  • আপনার বাড়িটা কি ধরণের ফাউন্ডেশনে হবে সেটাও ইঞ্জিনিয়ারের ডিসিশন।
  • আপনার বাড়িটা যে জমিতে হচ্ছে, সেটার মাটি কেমন, মাটি বাড়ি তৈরির জন্য যথেষ্ট উপযোগী কি না, যদি উপযোগী না হয় সেটাকে উপযোগী করে তোলা: এই সব কিছুর জন্য সয়েল টেস্ট থেকে রিপোর্ট অনুযায়ী সয়েল ডিজাইন করাও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব।

আর্কিটেক্ট এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এর মিল তাহলে কোথায়?

  • এরা দুজনেই ক্রিয়েটিভ প্রফেশনাল এবং উভয়ের মূল কাজ কনসালটেন্সি করা।
  • দুজনেই বাড়ির খরচ এবং নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন।
  • অভিজ্ঞতার সাথে সাথে দুজনেরই যোগ্যতা এবং ফি বাড়তে থাকে।
  • একজন ভাল আর্কিটেক্ট এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ব্যাপারে যথেষ্ট ধারণা থাকে।
  • একজন ভাল ইঞ্জিনিয়ার এর আর্কিটেকচার বিষয়ে অনেক জ্ঞান থাকে।
  • দুজনেই ইন্সটিটিউটের মেম্বার এবং অনেকটা একইরকম কোড-অফ-ইথিকস মেনে কাজ করেন।
  • দুটোই প্র্যাকটিক্যাল সাবজেক্ট। মাঠে কাজ করে হাত পাকানোর মাধ্যমেই তাঁদের যোগ্যতা প্রতিদিন বাড়ে।
  • দুজনেই প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট করতে পারেন।
  • দুজনেই ডিজাইন এবং কন্সট্রাকশন কোম্পানি চালাতে পারেন।
  • ঐতিহাসিকভাবে অনেক আর্কিটেক্ট সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অনেক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা ও প্র্যাকটিস করেছেন।
  • ইঞ্জিনিয়ার এবং আর্কিটেক্ট দুজনেই বিল্ডিং ছাড়াও আরও অসংখ্য জিনিস ডিজাইন করেন এবং অনেক সেক্টরে কাজ করার যোগ্যতা রাখেন। যেমন রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, ফ্যাক্টরি, ডিজাইন করেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। অন্যদিকে ইন্টেরিয়র, খেলার মাঠ, ফটোগ্রাফি ছাড়াও অনেক শাখাতেই সফলতার সাথে কাজ করছেন অনেক আর্কিটেক্ট।
আর্কিটেক্ট আর ইঞ্জিনিয়ারের টিম ওয়ার্ক নিয়ে আসে একটি যুগান্তকারী স্থাপনা!

একটা বাড়ি তৈরি হবার আগেই একজন আর্কিটেক্ট আপনাকে সেই বাড়িটা দেখতে সাহায্য করেন। বাড়িটা কেমন হবে, কি কি থাকবে, কি কি সুবিধা আপনার দরকার: আপনার সব ডিমান্ডগুলো জেনে আর্কিটেক্ট সেই বাড়িটা আপনার মানস-পটে গেঁথে দেন। এরপর একজন ইঞ্জিনিয়ার সেই বাড়িটা তৈরি করেন। বাড়িটা কিভাবে তৈরি হবে, কিভাবে খরচ কমিয়ে আপনার চাহিদাটা পূরণ করা যায়, কিভাবে আপনার বাড়িটা আরও মজবুত করা যায়: এ সব কিছু সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব। কিন্তু এর মানে এই না যে ডিজাইনের পর আর্কিটেক্ট কে আর দরকার নাই কিংবা আর্কিটেক্ট একাই ডিজাইন করে সেটাই ফাইনাল করে ফেলেন। প্রতিটা পদক্ষেপেই আর্কিটেক্ট আর সিভিল ইঞ্জিনিয়ার একসাথে কাজ করেন। দুজনের লক্ষ্য একটাই: আপনার বাড়িটা, আপনার বাজেটের মধ্যে যতটা সম্ভব আপনার মনের মত বানিয়ে দেয়া।

বাংলাদেশে এখনো আর্কিটেক্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারের কাজের পরিধি এবং তারা কি পারেন বা পারেন না সেই বিষয়ে সবার স্পষ্ট ধারণা নেই। যার কারণে চারিদিকে প্রচুর পরিমাণে ম্যাল-প্র্যাকটিস ছাড়াও ভুয়া আর্কিটেক্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারের ছড়াছড়ি। কোটি কোটি টাকার দায়িত্ব আমরা যার হাতে তুলে দিচ্ছি, তার সম্পর্কে একটু খোজ খবর অবশ্যই নেয়া উচিত। আপনার বাজেট কম হলে আপনি কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কারো কাছে যাবেন, তাতে কোনই বাঁধা বা দোষেরও কিছু নেই। কিন্তু তাকে তো অন্তত একজন আর্কিটেক্ট হতে হবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *