শুরু করি নিজের একটা গল্প দিয়ে। আমি লাইফ যে কোন সমস্যাতেই পড়ি না কেন, আমার বাবা মা’র কাছে সব সমস্যার সমাধান একটাই। “আগে আগে ঘুমাও, সকালে ঘুম থেকে উঠো, সব ঠিক হয়ে যাবে।

— “আব্বা, রেজাল্ট দিসে, ভালো হয় নাই”
— “হবার তো কারণ নাই, রাতে তো ঘুমাও না”
— “আম্মা, রাতে খাবো না, আজকে খিদা লাগে নাই”
— “তা লাগবে কেন, জাগো আরও রাত জাগো”

একদিন টেস্ট করার জন্য বলেছিলাম,
— “আমার মনে হয় এইডস হইসে”
— “হ্যাঁ হবেই তো আরও রাত জাগো…”

যাইহোক, সিরিয়াস কথায় আসি। অবশ্যই রাত জাগা খারাপ। রাত জাগার অপকারিতার শেষ নাই। এরপর ও জগতের সব ক্রিয়েটিভ লোক রাত জাগে। মোবাইল ফোন হাতে হাতে আসার পর থেকে অবশ্য রাত জাগার জন্য ক্রিয়েটিভ হওয়া এখন আর বাধ্যতামূলক না। তবুও ক্রিয়েটিভ লোকদের রাত জাগা আর সেটা নিয়ে বাকিদের অভিযোগ: এ চলে আসছে অনন্তকাল ধরে।

কিন্তু কথা হচ্ছে, আর্কিটেক্টরা রাত জাগে কেন? আপনি সবচেয়ে সফল একজন আর্কিটেক্টকে ধরুন কিংবা সদ্য ভার্সিটি পড়ুয়া আর্কিটেকচার স্টুডেন্টটাকে ধরুন, ৯০% চান্স যে তাঁর ঘুমের রুটিনের ঠিক নাই। প্রশ্ন হচ্ছে এটা কেন? আর এটা কতটা লজিকাল? আর্কিটেক্টদের রাত জাগাটা আসলে আর দশ জনের রাত জাগার চেয়ে একটু আলাদা। কেন তাঁরা রাত জাগেন আর কেনই বা তাঁদের রাত জাগাটা অন্য যে কোন পেশার মানুষের চেয়ে একটু আলাদা, সেটা নিয়ে আজকে আড্ডা দিব।

আর্কিটেক্ট কিন্তু রাত জাগে না! এ আবার কেমন আর্কিটেক্ট রে বাবা!

১। রোগের নাম ডেডলাইন

আর্কিটেক্ট জীবনে ডেডলাইন হল ডায়াবেটিক এর মত। ডায়াবেটিক যেমন একবার হলে এটা নিয়েই আপনাকে বাকি জীবন পার করতে হয়, আপনি একবার আর্কিটেকচার জীবনে ঢুকলে এই ডেডলাইন নিয়েই বাকি জীবন আপনাকে কাটিয়ে দিতে হবে। সে আপনি লুই আই কান হন কিংবা দেশের সবচেয়ে জঘন্য আর্কিটেক্ট: ডেডলাইন আপনার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যেতে বাধ্য। একজন আর্কিটেক্ট একসাথে অনেকগুলো প্রজেক্টে কাজ করেন। অনেক ক্ষেত্রে একটা প্রজেক্টে কাজ করলেও সেটা এত বড় হয় যে সেটা ভেঙে অনেকগুলো প্রজেক্টে ভাগ করে কাজ করা লাগে। আর এই প্রত্যেকটা কাজে প্রায় প্রতিদিন থাকে কোন না কোন ডেডলাইন। আর ডেডলাইন মানেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করা। আপনার কি মনে হয়, রোজ রোজ ডেডলাইন থাকলে সময়মত ঘুমানো সম্ভব?

২। শংকা থাকে রেপুটেশন নিয়ে

আমরা জানি, আপনার প্রজেক্ট আপনার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আপনি যেটা সম্ভবত জানেন না সেটা হচ্ছে আপনার প্রজেক্ট আপনার আর্কিটেক্ট এর কাছেও খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাবছেন, “এসব কথা তো সবাই বলে, সব নিজেদের ঢোল পিটানোর ধান্দা।” এখানেই আসলে আর্কিটেক্টদের ব্যাপারটা অন্যদের চেয়ে আলাদা। আর্কিটেক্টদের নিজেদের মধ্যে কমিউনিটিটা বেশ ছোট। কাজটা যেহেতু ক্রিয়েটিভ, তাই সবাই আসলে নজর রাখেন, আরেকজন আর্কিটেক্ট কি প্রজেক্ট করছেন, সেই প্রজেক্ট কতটা ইনোভেটিভ হচ্ছে, কি কি ইন্টারেস্টিং ডিজাইন বা ম্যাটেরিয়ালস ব্যবহার হচ্ছে। সব মিলিয়ে কোন একটা চমকের অপেক্ষা বাকি সবাই করেন। তাই একজন আর্কিটেক্ট আপনার প্রজেক্টটা শুধু পেমেন্টের জন্য কখনোই করেন না। আর্কিটেক্ট এর নিজের রেপুটেশন বা সুনাম ধরে রাখার ব্যাপারটা ও তাঁকে সমান গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হয়। এই অতিরিক্ত দায়িত্ববোধ তাঁকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আপনার কাজটা আরও পারফেক্ট করার জন্য জাগিয়ে রাখে। ক্রিয়েটিভ কাজে ভালোর যেহেতু কোন লিমিট নাই, তাই ডেডলাইনের শেষ সময় পর্যন্ত একজন আর্কিটেক্ট এর চেষ্টা থাকে ছোট একটা অংশও আরও কিভাবে ভালো করা যায়। ফলাফল: নো রাতের ঘুম!

৩। আর্কিটেক্টরা নীরবতা খোঁজেন

যে কোন ক্রিয়েটিভ কাজ ই চুপচাপ নিজের মত করতে হয়। আপনি একটা গান কম্পোজ করছেন, ১০ বার ফোন আসলো। ভাবেন তো গানের অবস্থা কি দাঁড়াবে? কিংবা একটা ছবি আঁকছেন, একটু পর পর কেউ দরজায় নক করছে। পারবেন মন মত ছবিটা আঁকতে? আর্কিটেক্টদের অবস্থাটাও তাই। দিনের একটা বড় সময় আর্কিটেক্টদের দিতে হয় ক্লায়েন্টদের পেছনে। ক্লায়েন্টদের ডিমান্ড বোঝা, সাজেশন দেয়া, সাইট ভিজিট, কন্সট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল সোর্সিং, কনট্রাক্টরদের পেছনে লেগে থাকা: ক্রিয়েটিভ ডিজাইন করা দূরে থাক, ভাবার সময় কই? তাই সবাই যখন গভীর ঘুমে, ফোন আসার কোন টেনশন নাই, টেনশন নাই ঠক ঠক দরজার আওয়াজের; আর্কিটেক্ট তখন তাঁর প্যাশনের বোতল খুলে বসেন। শুরু হয় চিন্তা, শুরু হয় এক মনে ডিজাইন নিয়ে কাজ করা। জন্ম হয়, চমৎকার কিছুর, যেটা হয়ত বাস্তবে রূপ নেবে আপনার বাড়ি হিসেবে।

রাতে সবার আড়ালে আর্কিটেক্টরা খোঁজেন নীরবতা!

৪। বেশিরভাগ আর্কিটেক্ট ইন্ট্রোভার্ট

হ্যাঁ, বেশিরভাগ আর্কিটেক্টরাই ইন্ট্রোভার্ট। তাঁরা তাঁদের ডিজাইন, কাজ আর চিন্তা ভাবনার মধ্যেই ডুবে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আর্কিটেক্টরা একটু সৌখিন ও বটে। নিজের মত কাজ করা, নিজেকে সময় দেয়া: এসব বেশিরভাগ আর্কিটেক্ট এর কাছে একটা বড় প্রায়োরিটি। আর নিজেকে সময় দেয়ার জন্য রাতের চেয়ে ভালো সময় আর কখন? অনেক আর্কিটেক্ট ই রাত জাগেন শুধু নিজের কাজের জন্য না; অনেকেই দেখা যায় পছন্দের অন্য কোন কাজ করছেন। কেউ সিনেমা দেখছেন, কেউ বই পড়ছেন, কেউ হয়ত মিউজিক নিয়ে পড়ে আছেন। অনেকে কিছুই করেন না, শুধু চিন্তা করেন। ইন্ট্রোভার্ট মানুষরা নিজেদের মত নিজেদের জগতে থাকতে চান। আর মাথার ভেতরের জগতটা সবচেয়ে বেশি আলোকিত হয় অন্ধকারেই।

৫। আপনার মত আর্কিটেক্টরাও অভ্যাসের দাস

হ্যাঁ, অভ্যাস। আর্কিটেক্টদের ছাত্রজীবন থেকেই বেশিরভাগ রাত কাটাতে হয় স্টুডিও তে। ডিজাইন নিয়ে গ্রুপ মেম্বারদের সাথে কাজ করা, প্রজেক্ট নিয়ে লেগে থাকা; এসব নিয়েই স্থাপত্য জীবন। এই জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অধ্যায়ের নাম ‘জমা’। অর্থাৎ প্রজেক্ট সাবমিশন। আর্কিটেক্টদের পড়াশোনার কালচারটাও এমন যে টিচাররাও চান যেন স্টুডেন্টরা দিন রাত জেগে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁদের ‘জমা’টার পেছনে কাজ করে। উদ্দেশ্য একটাই: কাজটা যাতে ভালো হয়। এই অভ্যাসে ৫ বছর কাটানোর পর আপনার কি মনে হয় আর কখনো স্বাভাবিক স্লিপ সাইকেলে ফেরা সম্ভব?

“ঘুম? সেটা আবার কি?” — জনৈক আর্কিটেক্ট

শেষে বলি, এই লেখার উদ্দেশ্য কিন্তু এটা বোঝানো না যে রাত জাগা ভালো। রাত জাগার জন্য নব্য আর্কিটেক্ট বা ভর্তিচ্ছু আর্কিটেকচার স্টুডেন্টদের উৎসাহ দেয়াও এই লেখার উদ্দেশ্য না। এই যে বোল্ড করে লিখে দিচ্ছি, সবার উচিৎ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে আগে আগে উঠে যাওয়া, একটা সুস্থ জীবন যাপন করা। আমরাও তাই চাই। কিন্তু চাইলেও তো আর পারা যাচ্ছে না ভাই। আর কেন পারা যাচ্ছে না, সেগুলো নিয়েই তো এতক্ষণ প্যাঁচাল পাড়লাম!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *